সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে বসেছে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির আবদুল জব্বারের শতবর্ষী বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা। তিনদিনের এ মেলায় দ্বিতীয় দিন সোমবার (২৫ এপ্রিল) সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মেলা মোটামুটি জমলেও অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে মানুষের উচ্ছ্বাস কম। বেপারিরাও সীমিত পরিসরে পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন। বলীখেলা ঘিরে আশপাশের এলাকাজুড়ে বসেছে লোকজ মেলা। প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নামিদামি বলীরা এরইমধ্যে নাম তালিকাভুক্ত করেছেন।
মেলায় পণ্য নিয়ে আসা বেপারিরা বলছেন, গত দুই বছরের মতো এবারও মেলা হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। যে কারণে অনেক বেপারি পণ্য নিয়ে মেলায় আসেননি। যারা এসেছেন তারাও পণ্য কম এনেছেন। আবার রমজানের কারণেও মেলায় বেচাকেনা কম।
মেলা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর এবার মেলা অনুষ্ঠান নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ায় মেলা কম জমেছে। তবে দেশের নানা প্রান্ত থেকে জনপ্রিয় বলীরা এরইমধ্যে এসেছেন।
সোমবার দুপুরে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, আন্দরকিল্লা থেকে শুরু করে কোতোয়ালী মোড় পর্যন্ত এবং কেসি দে রোড, জেল রোডসহ আশেপাশের গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন বেপারিরা। সুঁই সুতা থেকে শুরু করে গৃহস্থালি তৈজসপত্র, দা, ছুরি, খন্তিও পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। বাগান সামগ্রী ও বিভিন্ন জাতের ফুল-ফলের গাছ উঠেছে মেলায়। অনেক গাছে রীতিমতো ঝুলে আছে আম, গাব, ডালিম ও পেয়ারা। কোথাও রকমারি মাটির পণ্য, কোথাও বেতের, কোথাও কাঠের তৈরি পণ্য। গ্রামীণ মেলার ঐতিহ্য বাঙালির লোকজ মেলার পুরোপুরি উপস্থিতি দেখা গেছে শতবর্ষী ঐতিহাসিক জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলায়ও।
প্রায় ৩২ বছর ধরে জব্বারের বলীখেলায় আসেন নরসিংদীর সৈয়দ শাফিউদ্দিন। তিনি হাতের তৈরি কুলা, চালন, হাতপাখাসহ নানা কারুকাজের জিনিসপত্র নিয়ে এবারও এসেছেন মেলায়। শাফি উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে মেলায় আসি। করোনার কারণে দুই বছর আসা হয়নি। এবার এসেছি, তবে বেচাবিক্রি একেবারে কম। মেলায় লোকজনও কম।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকার আসকর আলী জব্বারের বলীখেলায় আসেন প্রায় ২০ বছর ধরে। তিনি জানান, জব্বারের বলীখেলায় আসার জন্য আমাদের পুরো বছরের প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু গত দুই বছর আসা হয়নি। এবারও মেলা হওয়া না হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। যে কারণে মালামাল কম এনেছি। আজ মেলার দ্বিতীয় দিন, কিন্তু লোকজন অর্ধেকও নেই।
বাঁশখালীর ওবায়দুল্লাহ জব্বারের বলীখেলায় প্রায় ৩৫ বছর ধরে হাতের তৈরি পাখা বিক্রি করেন। তিনি বলেন, আমি চন্দনাইশের তালপাতার তৈরি হাতপাখা বিক্রি করি। করোনা ছিল দুই বছর। এবারও মেলা হবে কি না, সন্দেহ ছিল। তাই বেশিরভাগ লোকজন হাতপাখা তৈরি করেনি। আগের চেয়ে হাতপাখা তৈরির খরচ বেড়েছে। এবার মেলায় পণ্য কম এলেও বেচাকেনা আশাব্যঞ্জক হচ্ছে।
মেলায় ৩০ বছর ধরে শুকনো খাবার বিক্রি করেন পশ্চিম পটিয়ার দেবু বর্ধন। খই, মুড়ির মোয়া, চনামনার ঠ্যাং, জিলাপি, তিলের খাজাসহ নানান বাঙালিয়ানা খাবার নিয়ে মেলায় আসেন তিনি। দেবু বর্ধন বলেন, রমজান মাস। তাই খাবার পণ্য হিসেবে বেচাকেনা একেবারেই কম। তবে ইফতারের পর বেচাকেনা বাড়বে বলে আশা তার।
মেলায় শীতল পাটি নিয়ে এসেছেন পটিয়া দক্ষিণ ভূর্ষি গ্রামের সজল নাথ। তিনি বলেন, বেতের শীতল পাটির কদর এখনো রয়েছে। আমাদের কাছে ৭-৮ হাজার টাকা দামের পাটিও রয়েছে। গ্রামেগঞ্জে এখন বেত পাওয়া যাচ্ছে না। আবার প্লাস্টিকের পাটিও বাজারে চলে এসেছে। তবে শীতল পাটির ঐতিহ্যের পাশাপাশি একটি রাজসিক ভাব রয়েছে। কদরও রয়েছে।
দেশে করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে গত দুই বছর (২০২০ ও ২০২১ সাল) জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়নি। এ বছরও মেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। মাঠ ব্যবহার অনুপযোগী থাকায় গত ১৪ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে মেলা ও বলীখেলা স্থগিতের ঘোষণা দেয় আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও মেলা কমিটি। দুদিন পরই সিদ্ধান্তে বদল আসে। ২৪ এপ্রিল শুরু হওয়া মেলা চলবে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত।
আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও মেলা কমিটি সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, দুই বছর করোনার জন্য মেলা ও বলীখেলা হয়নি। লালদীঘি মাঠ প্রস্তুত না থাকায় এবারও সংশয় ছিল। বলীখেলায় দেশের সেরা বলীরা এরইমধ্যে এসেছেন। আগের বারের চ্যাম্পিয়ন রানারআপরাও এসেছেন।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার ১৯০৯ সালে (১৩১৬ বঙ্গাব্দের ১২ বৈশাখ) এ বলীখেলার সূচনা করেন। তার মৃত্যুর পর এ প্রতিযোগিতা জব্বারের বলীখেলা নামে পরিচিতি পায়। এবার বলীখেলার ১১১তম আসর বসেছে। বলীখেলা ঘিরে প্রতি বছর লালদিঘী মাঠের আশপাশে দু-তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। এটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বৈশাখী মেলা হিসেবে পরিচিত।