স্টাফ রিপোর্টার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ইজারার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে মেঘনা নদীতে ফ্রিস্টাইলে চলছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। প্রতিদিন প্রায় ২০টি ড্রেজার দিয়ে নদীর চর ঘেঁসে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এমনকি সুযোগ বুঝে ড্রেজার লাগিয়ে মেঘনা চরের ফসলি জমি পর্যন্ত কেটে ফেলা হচ্ছে। এতে করে চরে ব্যাপক ভাঙ্গনের সৃষ্টি হবার পাশাপাশি তীরবর্তী চরলালপুর গ্রাম হুমকির মুখে পড়েছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করছে।
জানা যায় সম্প্রতি জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার চরলালপুর ও নবীনগর উপজেলার চর কেদারখোলা দুটি বালু মহাল ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। দুটি বালু মহালেরই ইজারা পেয়েছেন মেসার্স মৌসুমী ড্রেজিং সার্ভিস। যার স্বত্বাধিকারি পাশর্^বর্তী ভৈরব উপজেলার প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ নেতা মোশারফ হোসেন মিন্টু। সম্প্রতি চরলালপুর বালু মহালের ইজারামূল্য জমা দিয়ে বালু উত্তোলন শুরু করে ইজারাদার। কিন্তু দুএকদিন যেতে না যেতেই ইজারায় উল্লিখিত এলাকা থেকে তারা বালু উত্তোলন না করে উত্তোলন খরচ কমাতে এবং অতিরিক্ত বালু পাবার লোভে নদীর চর ঘেঁসে বালু উত্তোলন শুরু করে ইজারাদার। এমনকি সুযোগ বুঝে ড্রেজার লাগিয়ে তারা মেঘনা চরের ফসলি জমির মাটি কেটে নিতে থাকে। এতে করে সংশ্লিষ্ট জমির বন্দোবস্ত পাওয়া ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। এছাড়া ড্রেজার দিয়ে মাটি কেটে ফেলার কারণে চরে ব্যাপক ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। এতে নদীর তীরবর্তী চরলালপুর গ্রামের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয় গ্রামবাসীর মনে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় উপজেলার লালপুর বাজারের কাছে মেঘনার চর ঘেঁসে ২০টি ড্রেজারের সাহায্যে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই চরের বিরাট অংশের ফসলি জমি কেটে ফেলা হয়েছে। কাটা অংশে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক ভাঙ্গন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় প্রতিটি ড্রেজার প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার ঘনফুট বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে। সে হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ১০ লক্ষ ঘনফুট বালু উত্তোলিত হচ্ছে। এভাবে চর ঘেঁসে বালু উত্তোলন করতে থাকলে খুব অল্প সময়েই চরের একটি অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে তীরবর্তী গ্রাম হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তথ্যানুসন্ধ্যানে জানা যায়, চরের এসব জমি নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকার ভূমিহীনদের নামে বন্দোবস্ত দিয়েছে। প্রতিবছর ধান, গম, কাউন, মিষ্টি আলো, তরমুজ ও সরিষাসহ নানান জাতের ফসল হত এসব জমিতে। ভূমিহীন চাষী ও গ্রামবাসীরা জানান, ইজারা পেয়ে বালু উত্তোলন শুরু করার পর মাত্র দু-একদিন তাদের সীমানায় বালু উত্তোলন করা হয়। এরপর থেকেই তারা চর ঘেঁসে বালু উত্তোলন করতে থাকে এবং রাতবিরাতে ফসলি জমির মাটি কেটে নিয়ে যায়। গ্রামবাসী চরে উপস্থিত হলে ড্রেজার ভাসিয়ে দূরে নিয়ে যাওয়া হয়। চর ঘেঁসে মাটি কাটতে নিষেধ করায় ইজারাদারের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে ভূমিহীন কৃষকদের অভিযোগ।
চরে বন্দোবস্ত পাওয়া ভূমিহীন কৃষক আহাদ মিয়া, বশির মিয়া, জয়নাল মিয়া, কালো মিয়া, আবুল খায়ের ও আবু বক্কর মিয়া জানান, গত দু-তিন দিনে তাদের প্রায় ৫ কানী (১৫০ শতাংশ) জমির মাটি কেটে নদীতে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে। যেসব জমিতে প্রতিবছর ধান, গম, কাউন, মিষ্টি আলো, তরমুজ ও সরিষাসহ নানান জাতের ফসল উৎপাদন হত এসব জমির এখন আর অস্থিত্ব নেই। এসব জমির উপর তাদের জীবিকা নির্ভর ছিল এবং বর্ষা মৌসুম শেষে এখনই জমিতে ফসল ফলানোর স্বপ্ন দেখছিল তারা। অবিলম্বে চর ঘেঁসে মাটি কাটা বন্ধ করাসহ জমির ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন কৃষকরা। এদিকে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে ভূক্তভোগি কৃষকরা আদালতের শরণাপন্ন হলে বিষয়টি সরেজমিনে দেখতে অ্যাডভোকেট কমিশন গঠন করে। গত শুক্রবার কমিশনের অ্যাডভোকেট রুহুল বাসার খান জসীম সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এসময় লালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা মোরশেদ মাস্টার ও ইউনিয়নের উপসহকারি ভূমি কর্মকর্তা সৈয়দ ইব্রাহীম আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে আদালত গঠিত কমিশনের অ্যাডভোকেট রুহুল বাসার খান জসীম খান বলেন, বালুু মহালের সমিানা অতিক্রম করে ইজারাদার চরের ফসলি জমির মাটি কেটে নিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতিয়মান হয়েছে। আমি সরেজমিনে যা দেখেছি তাই প্রতিবেদনে উল্লেখ করব।
ইউনিয়নের উপসহকারি ভূমি কর্মকর্তা সৈয়দ ইব্রাহীম আহমেদ বলেন, বালুু মহালের সমিানা অতিক্রম করে ইজারাদার কর্তৃক চরের ফসলি জমির মাটি কাটার বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে এবং শিঘ্রই সার্ভে করে বালু মহালের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়া হবে। লালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা মোরশেদ মাস্টার সরকার ইজারা দিয়েছে বালু মহালের সীমানার মধ্যে বালু উত্তোলন করলে এলাকাবাসীর কোন অভিযোগ থাকবেনা। তবে যেভাবে চর কেটে ফসলি জমি নষ্ট করা হচ্ছে- এভাবে চলতে থাকলে চরের একটি অংশ নদীগর্ভে বিলীন হওয়াসহ তীরবর্তী গ্রাম হুমকির মুখে পড়বে। আমরা এর প্রতিকারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করি। তবে বালু মহালের ইজারাদার মেসার্স মৌসুমী ড্রেজিং সার্ভিসের স্বত্বাধিকারি মোশারফ হোসেন মিন্টু বলেন, আমরা ড্রেজারগুলিকে আমাদের নির্ধারিত সীমানার মধ্যে থাকার নির্দেশ দিয়েছি। সরকারকে রাজস্ব দিয়ে ইজারা নিয়েছি। কারো ক্ষতি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। এ ব্যাপারে আশুগঞ্জের সহকারি কমিশনার (ভূমি) কাজী তাহমিনা সারমিন বলেন, ইজারাদাকে বালু মহালের নির্ধারিত সীমানার মধ্যে বালু উত্তোলনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শিঘ্রই সীমানা নিশান লাগিয়ে দেয়া হবে। ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে অভিযোগ টি তদন্ত করে দেখা হবে।